লিচু ফুলের মধু

মধু উচ্চ ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি ভেষজ তরল এবং সুপেয় পানীয় হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি মধুর নানা ঔষুধী গুণাবলী রয়েছে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় প্রাচীনকাল থেকে মধু ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রকৃতিতে হরেক রকমের মধু রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন মধু স্বাদ ও গন্ধে আলাদা। বিভিন্ন প্রকার মধুর মধ্যে লিচু ফুলের মধু অন্যতম। লিচু ফুলের মধু খুবই সুস্বাদু এবং সুঘ্রাণযুক্ত হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে এই মধুর বিশেষ সমাদর রয়েছে৷ বিশেষ করে বাচ্চারা এই মধু খেতে খুবই পছন্দ করে৷

লিচু ফুলের মধুর বৈশিষ্ট্য

লিচু ফুলের মধুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি দেখতে সাধারনত হালকা হলুদ রঙের হয়। তবে মধু সংগ্রহের সময়, মধুতে লিচু ফুলের নেক্টারের শতকরা পরিমাণ, স্থান  এবং ঘনত্বের উপর নির্ভর করে মধুর রঙ হালকা বা গাঢ় হতে পারে৷ এই মধু খেতেও বেশ সুস্বাদু হয়ে থাকে। এতে লিচু ফলের মত স্বাদ এবং ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তবে প্রাকৃতিক মৌচাকের মধুতে বিভিন্ন ফুলের নেকটারের সংমিশ্রণের জন্য এই স্বাদের ভিন্নতা তৈরি হতে পারে৷

এই মধুর ঘনত্ব গাঢ় কিংবা পাতলা উভয়ই হতে পারে৷ ঘনত্ব বেশি পাতলা হলে মধুতে ফেনা হতে দেখা যায়। মধুর ঘনত্ব বেশি হলে ফেনা হতে দেখা যায় না। একটি নির্দিষ্ট সময় পর আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ  জমে যাওয়া লিচু ফুলের অন্যতম বৈশিষ্ট৷ তবে মধু আংশিক বা সম্পূর্ণ জমা নির্ভর করবে মধুর ঘনত্ব এবং বিভিন্ন ফুলের নেকটারের আধিক্যতার উপরে।

লিচু ফুলের মধুর উপাদান

লিচু ফুলের মধুর প্রধান উপাদান হলো শর্করা, গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ।এছাড়া লিচু ফুলের মধুতে আরও কিছু গুরুত্বপুর্ণ উপাদান রয়েছে। তার মধে মিনারেল, এনজাইম, ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৫, বি৬ এবং অল্প পরিমানে ভিটামিন সি, থায়ামিন এবং নিয়াসিন উল্লেখযোগ্য।

বিস্তারিত পড়ুন, – মধুর প্রধান উপাদান কি

লিচু ফুলের মধু কিভাবে সংগ্রহ করা হয়

সাধারণত মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে আমাদের দেশে লিচু গাছগুলিতে প্রচুর মুকুল হতে দেখা যায়৷ এসময় মৌমাছিরা লিচু ফুলে ঘুরে-ঘুরে ফুলের নেকটার সংগ্রহ করে তাদের মৌচাকে জমা করে৷ এভাবেই উৎপন্ন হয় বা লিচু ফুলের মধু৷

প্রকৃতি যখন লিচু ফুলে ভরে যায় তখন আমাদের দেশের মৌচাষিরা তাদের খামারের মৌ-বাক্স গুলি বিভিন্ন বড়-বড় লিচু বাগানে স্থাপন করে থাকেন৷ মৌ-বাক্সে থাকা মৌমাছিরা লিচু বাগানের প্রায় প্রতিটি মুকুল থেকেই নেকটার সংগ্রহ করে তাদের মৌ-বাক্সে জমা করে৷ পরবর্তিতে, মৌচাষিরা মৌবক্সের মৌচাক গুলি থেকে এক্সট্রাক্টর নামক বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে মধু বের করে নেন৷ এভাবে যে মধু সংগৃহীত হয় এটাকে বলা হয় লিচু ফুলের মধু৷ খামারে উৎপাদিত মধুও অবশ্যই প্রাকৃতিক মধু৷

লিচু ফুলের মধুর উপকারীতা

লিচু ফুলের মধুর উপকারিতা

লিচু ফুলের মধু অত্যন্ত উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন।রান্নার কাজে ব্যবহার করা ছাড়াও লিচু ফুলের মধুর নানা স্বাস্থ্য উপকারীতা রয়েছে।

  1. লিচু ফুলের মধু শর্করা, মিনারেল, ভিটামিন,এবং প্রচুর অ্যান্টিআক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এই উপাদান গুলো শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ, হজমের সমস্যা সহ পেটের নানা সমস্যা  মোকাবেলায় অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা রাখে।
  2. এছাড়া মধু তে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার ফলে ঠান্ডা,কফ, কাশি,গলা ব্যাথা ইত্যাদি শারীরীক জটিলতা সহজেই দূর হয়ে যায়। ত্বকের জ্বালা পোড়া এবং প্রদাহ দুরীকরণেও এই উপাদান গুলো দারুন অবদান রাখে।
  3. উচ্চ রক্তচাপ মোকাবেলায় লিচু ফুলের মধু দারুন কার্যকর। লিচু  ফুলের মধু তে থাকা ফেনোলিক এসিড, এন্টিওক্সিডেন্ট, এন্টিএনফ্ল্যেমেটরী বৈশিষ্ট্য রক্তচাপ কমাতে ভুমিকা রাখে। যার ফলে সার্বিকভাবে হার্টের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
  4. হাড় এবং দাত গঠনে লিচু ফুলের মধুর ভুমিকা রয়েছে। নিয়মিত ভাবে লিচু ফুলের মধু সেবন করলে সামগ্রীকভাবে হাড় এবং দাতের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে।
  5. ত্বকের চিকিতসায় লিচু ফুলের মধু দারুন উপকারী। ব্রণ, একনি, একজিমা সহ ত্বকের তেল চিটচিটে ভাব এবং ত্বকের রুক্ষতা দুরীকরণে লিচু ফুলের মধু অনেক কার্যকর।
  6. প্রাকৃতিক ভাবে অনিদ্রা সমস্যা সমাধান করতে মধুর উপকারিতা লক্ষনীয়। মধু মানবদেহে সেরেটোনিন ও মেলাটোনিন তৈরি করে যা ভালো ঘুম নিশ্চিতে সহায়ক। এছাড়াও লিচু ফুলের মধু সেবন মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা এবং উদ্ধেগ কমাতে ভুমিকা রাখে।

এগুলো ছাড়াও মধুর আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে। এ সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত আর্টিকেলটি পড়ুন – মধুর উপকারিতা এবং আদ্যোপান্ত।

লিচু ফুলের মধু কি তেতো হয়ে যায়?

এটি একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলেও সত্যি যে, লিচু ফুলের মধু খেতে যেমন খুবই সুস্বাদু তেমনি এই ফুলের মধু যদি নিম্নমানের হয় তবে মধু সংগ্রহের কয়েক মাস পরে মধুতে হালকা তেতোভাব আসতে পারে৷ সাধারণত নিম্নমানের মধু যেমন সি গ্রেডের মধুতে এই হালকা তেতোভাব তৈরি হতে বেশি দেখা যায়৷ বি গ্রেডের মধুর বয়স দীর্ঘদিন হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে মধুতে হালকা তেতোভাব আসতে পারে৷ তবে এ গ্রেডের মধুতে এমনটা হতে সাধারণত দেখা যায় না৷ তবে, এই তেতোভাবটা যে খুব একটা প্রকট তা নয়৷ মধু খাওয়ার পরে গলাতে হালকা তেতো অনুভব হতে পারে৷

লিচু ফুলের  মধু  চেনার উপায়

অনেকেই লিচু ফুলের মধু চিনতে ভুল করে থাকেন। সহজে লিচু ফুলের মধু চেনার উপায় হচ্ছে এই মধু দেখতে  অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার। এছাড়াও Ph মাপার মেশিন থাকলে খুব সহজেই আসল বা ভেজাল লিচু ফুলের মধু চেনা সম্ভব। সাধারনত মধুর গড় pH মান ৩.৯ ৷  তবে এর মান ৩.৪ থেকে ৬.১ পর্যন্ত হতে পারে৷ যদি আপনার মধুতে pH মান এর ব্যতিক্রম হয় তাহলে টা ভেজাল মধু হিসেবে গন্য হবে। লিচু ফুলের মধু চেনার আরো একটি উপায় হচ্ছে এই মধু সবসময় পাতলা ও ফ্যানাযুক্ত হবে। পাত্রে আটকে রাখলে পাত্রের মধ্যে গ্যাস তৈরি হবে এবং ঝাঁকি দিলে অবশ্যই ফ্যানা উঠবে। অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন লিচু ফুলের মধু কি জমে? হ্যা, লিচু ফুলের মধু শীতকালে  কিছুটা জমতে পারে যা লিচু ফুলের মধু চিনার একটি সহজ উপায়। খাটি লিচু ফুলের মধু জমে গেলে যদি ঘি বর্ন ধারণ করে (যা বর্তমানে ক্রিম হানি নামে পরিচিত) তাহলেও তা লিচু ফুলের মধু হিসেবে চেনা যায়। জমে যাওয়া মধু জিহবায় নিলে সাথে সাথে গলে যায় এবং খেতে গ্লুকোজের  মত লাগে৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart